বাসে উঠবার আগে হোটেল থেকে ইহরাম পরে নিয়েছিলাম। এই ইহরাম পরেই হজ বা উমরার আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। ইহরাম হচ্ছে দু-টুকরো সেলাইবিহীন শুভ্র পোষাকের গাত্রাবরণী। একটি পরিধানের জন্য, একটি গায়ে জড়ানোর জন্য। হজ হচ্ছে এক রুহানি ভ্রমণ। আর ইহরাম হচ্ছে এই ভ্রমণের রুহানি পোশাক। এ পোশাক পরে হজ যাত্রীকে শুধু শারীরিক নয়, মানসিক প্রস্তুতি নিতে হয়।
এ প্রস্তুতি একমাত্র আল্লাহর জন্য। কোনো রকম জাগতিক প্রয়োজনের জন্য নয়।আমার অনেক বিদেশি বন্ধু জিজ্ঞাসা করেছে, তোমরা যা চাও সেটা তো এ পোশাক না পরেও হতে পারে। আমি তাদের বলেছি, হলেও হতে পারে। তবে ইসলাম হচ্ছে হাতে-কলমে কাজে-কর্মে দেখিয়ে দেবার ধর্ম। শুধু মুখে মন্ত্র পড়ে সে কিছু করতে চায় না। ইহরাম হচ্ছে একটা প্রতীক। এই প্রতীকের তলায় একটা গভীর মর্ম লুকিয়ে আছে।কী সেই মর্ম?শরীরের সবকিছুু খুলে ফেলে সামাজিক অবস্থানের চিহ্নগুলোকে নির্মূল করে দেওয়া হচ্ছে হজের মূলকথা।
এই দু-টুকরো পোশাক সব ধরনের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ভিন্নতাকে মুছে দিয়ে আল্লাহর সামনে সবাইকে সমান হিসেবে হাজির করে। আমির, রইস, বাদশাহ, শেখ, আরব-অনারব, মাশরিক-মাগরিব যেই হোক না কেন–এই সাধারণ পোশাক পরে আল্লাহর সামনে অনুগ্রহপ্রার্থী হতে হয়। লক্ষ লক্ষ মানুষ এই পোশাক পরে হজ করতে আসে। এরা কেউ কারও ওপরে নয়।ইহরাম পরে হজ যাত্রীকে তার ইগোকে বিসর্জন দিতে হয়।
এই ইগো হজের কালেকটিভ ইগোর মধ্যে হারিয়ে যায়। এটাকেই বলে মিল্লাত। হজ এই মিল্লাতের চেতনা সৃষ্টি করে।ইহরামের আর একটা মর্ম হচ্ছে, আমরা মৃত্যুর পরে লাশকে শুভ্র বস্ত্রে আবৃত করে বিদায় জানাই। এই শুভ্র ইহরাম আমাদের মনে করিয়ে দেয়, মানুষের মৃত্যু আসে অগোচরে, নিভৃতে, আচমকা কোনো ঘোষণা না দিয়ে এবং কারও সাথে কোনো পার্থক্য না করে। শুভ্র এ দুটি বস্ত্র খণ্ড পরিধান করে একজন মানুষ জীবন থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে এবং মৃত ব্যক্তিদের সঙ্গী হয়। সংসারের চিন্তা থেকে বিযুক্ত হয়ে সে সব ধরনের পার্থিব আকাক্সক্ষাকে বিসর্জন দেয়।
সে আসলে কাফনের পোশাক পরে আল্লাহর সান্নিধ্যে উপনীত হয়। হজের সময় এই বিশেষ ভাবনাটা মুসলমানের চেতনাকে নাড়া দেয়, যাতে সে কোনো খারাপ কাজ না করে। হজ মানুষের জিন্দেগী বদলে দেয়। যে বদলায় না, তার ওপর হজের রুহানিয়াতের ছাপ পড়ে না।ইহরাম শব্দটা এসেছে আরবি হারাম শব্দ থেকে, যার মানে নিষিদ্ধ। ইহরাম পরা অবস্থায় একজন হজ যাত্রী কিছু নিষেধাজ্ঞার আওতার মধ্যে থাকে।
এ নিষেধাজ্ঞার উদ্দেশ্য মূলত নৈতিক। হজের সময় প্রতীকীভাবে হলেও এই নৈতিক অবস্থা যাতে বাকি জীবন ধরে রাখা যায়, তাই এর উদ্দেশ্য।ইহরাম পরতে হয় নির্দিষ্ট ভৌগলিক সীমানার মধ্যে। এটাকে বলা হয় মীকাত। যেমন মদিনা থেকে যারা মক্কায় যায়, তারা মসজিদে নববি থেকে সাত কিলোমিটার দূরে জুল হুলাইফা নামক স্থানে ইহরাম পরে নিয়ত করে। মদিনা থেকে হজে যাবার পথে নবিজি এটিকে মীকাতের স্থান হিসেবে নির্বাচন করেন।আমাদের বাস এতক্ষণে মদিনা শহর ছাড়িয়ে মক্কা অভিমুখী মহাসড়ক ধরে চলতে শুরু করেছে। দুপাশে সমুন্নত শিলীভূত পাহাড়, মাঝে মাঝে মরুভূমির বিস্তার, ওপরে দিগন্ত রেখা বরাবর আকাশ–এই ত্রয়ীর করস্পর্শে আমাদের কাফেলা এগিয়ে চলেছে।
পুরো মক্কা অবধি একই রকম ল্যান্ডস্কেপ। প্রায় জনশূন্য। মাঝে মাঝে দু-একটি আবাদি চোখে পড়ে। হয়তো দু-এক পাল উটও নজরে আসে। কিন্তু বেদুইনদের সেই তাঁবু, মরুচারী বোহেমিয়ান জীবন, কারাভাঁর ঘণ্টাধ্বনি এখন আর দৃষ্টিগোচর হয় না। এরা সবাই সামাজিক ও নাগরিক জীবনে আত্মস্থ হয়ে গেছে। অথবা বলব, আধুনিক সভ্যতা এদেরকে আত্মস্থ করে ফেলেছে। এদের উন্মুক্ত জীবনধারা, গৃহের বন্ধনহীন মরুভূমির আমন্ত্রণ অনেকখানি সংকুচিত হয়ে গেছে।
ক্যাটাগরি: ভ্রমণ ও প্রবাস
প্রকাশনী: গার্ডিয়ান পাবলিকেশন্স
পৃষ্ঠা সংখ্যা: 44
মূল্য: 120 টাকা