খারেজিদের সংখ্যা ছিল অনেক কম কিন্তু তাদের আন্দোলনটি ছিল বেশ মৌলিক। কাজকর্ম ছিল অনেকটা উগ্রপন্থী টাইপের।
তাদের ধর্মদর্শনের মূল চাহিদা ছিল বিশুদ্ধতা। তারা বলত, মুসলমানদের নেতা হতে পারবে কেবল সেই ব্যক্তি যে অক্ষরে অক্ষরে ধর্মীয় বিধিবিধান মেনে চলবে। এর থেকে যার বিচ্যুতি ঘটবে সে কখনোই নেতা থাকতে পারবে না। তাই কোনো ধর্মনিরপেক্ষ বা হালকাভাবে ধর্ম পালন করা ব্যক্তি খারেজিদের বিবেচনায় শাসক হওয়ার যোগ্য ছিল না।
খারেজিরা তাদের এই দর্শন এর পরিণতি কিংবা বাস্তবতা না ভেবেই প্রচার করত। অর্থাৎ আদৌ এই মানের কোনো ব্যক্তি আছে কি না কিংবা এতগুণে গুণান্বিত কোনো ব্যক্তি না পাওয়া গেলে কীভাবে শাসন কাজ পরিচালনা হবে- এসব নিয়ে তাদের কোনো ব্যাখ্যাও পাওয়া যায়নি।
কিন্তু স্বাভাবিকভাবে, কেউ ক্ষমতায় থাকলে তার দমন বা নিপীড়নের কারণে যখনই অন্য কেউ নিজেকে বঞ্চিত বা শোষিত মনে করত তখনই খারেজিরা তার কাছে গিয়ে তাদের বিশুদ্ধ নেতা সংক্রান্ত মতবাদ প্রচার করত। তাকে শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার জন্য উসকে দিত।
সময় যত গড়ায়, খারেজিরা আস্তে আস্তে দুর্বল হয়ে পড়ে। কারণ, তারা এত বেশি শুদ্ধতা চাইছিল যে, ওই সময়ে তা মোটেও সম্ভব ছিল না। প্রকারান্তরে বস্তুবাদী শাসন ব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে অর্থশালী লোকের সংখ্যাও ক্রমশ বাড়ছিল। সমাজে অসন্তুষ্ট কেবল তারাই ছিল যারা অর্থনৈতিকভাবে এগোতে পারছিল না। কিন্তু তারাও সেই আনন্দহীন কাঠখোট্টা জীবন মেনেও নিতে রাজি ছিল না, যা খারেজিরা কায়েম করতে চাইত।
সেই কারণে খারেজিরা খুব একটা সুবিধা করতে পারছিল না। কিন্তু শিয়ারা উমাইয়া শাসন ব্যবস্থার জন্য সত্যিকারের হুমকি হয়েই থেকে গেল। আর ইমাম হুসাইন (রা.)-এর শাহাদাতের পর এই হুমকিটি ক্রমাগতভাবে যেন আরও প্রকট হয়ে উঠেছিল।
অবশ্য শিয়া ইমামরা কখনো সরাসরি সিংহাসনকে চ্যালেঞ্জ করেননি। তারা চেষ্টা করেছিলেন খলিফা থেকে ইমামের সংজ্ঞা ও পরিপ্রেক্ষিতকে আলাদা রাখতে। তাদের চেষ্টা ছিল ইমাম খেতাবটাকে ধর্মীয় আঙ্গিকে বেশি প্রয়োগ করার।
কিন্তু শিয়াদের মধ্যে যারা কট্টর ছিল তারা এই ইমামদের নামকে ব্যবহার করেই বিভিন্ন জায়গায় সংকট সৃষ্টি বা বিদ্রোহ সূচনা করার চেষ্টা চালিয়ে যায়। তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল হজরত আলি (রা.)-এর বংশধর কাউকে ক্ষমতায় নিয়ে আসা। তারা এই মর্মেই প্রচার করত যে, খলিফার পদটি উমাইয়াদের পাওয়ার কোনো সুযোগই নেই।
শিয়াদের এই হুমকিটি ছড়িয়ে পড়ছিল। কারণ, উমাইয়া শাসনামলে বেশ কিছু নির্মম ঘটনা কিছু নিপীড়িত মানুষকেও একই জায়গায় নিয়ে এসেছিল। যেমন : উমাইয়া আমলে শিয়ারাই ছিল ধর্মীয় সকল গোত্রগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি লাঞ্ছিত।
মুসলমানদের মধ্যে যতগুলো নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী ছিল তার মধ্যে আবার সবচেয়ে বেশি লাঞ্ছিত ছিল পারস্যের মুসলমানরা। তাই শিয়ারা লড়াই শুরু করেছিল মূলধারার ধর্মীয় প্রশাসনযন্ত্রের বিরুদ্ধে। অন্যদিকে, পারসিয়ানরা লড়াই শুরু করেছিল আরবঘেঁষা প্রশাসনের বিরুদ্ধে।
এভাবে শিয়া এবং পারসিয়ানরা পরস্পরের কাছে চলে আসে। পারসিয়ানদের অনেকেই শিয়া মতবাদে যোগ দেয় আর অন্যদিকে শিয়ারাও পারসিয়ানদের মধ্য থেকেই লোক নিয়োগ করতে শুরু করে।
আর এই দুই গ্রুপের ঘনিষ্ঠতায় বিভিন্ন জায়গায় বিদ্রোহ দানা বেঁধে ওঠে। বিশেষ করে সাম্রাজ্যের পূর্বাঞ্চলে এই বিদ্রোহটি বেশ বড়োসড়োভাবে দেখা দেয়। উমাইয়াদের আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সেই বিদ্রোহ দমনে হিমশিম খেতে শুরু করে।
ক্যাটাগরি: ইতিহাস ও সভ্যতা
প্রকাশনী: গার্ডিয়ান পাবলিকেশন্স
পৃষ্ঠা সংখ্যা: 472
মূল্য: 460 টাকা