ধরণির পথে পথে একটি অসাধারণ বই রিভিউ পড়ুন
ln.Author: গার্ডিয়ান পাবলিকেশন্স
: Sep 17, 2024
: ১২৩
লেখক পরিচিতি:
স্যার জিয়াউল হক পুরোদস্তুর লেখক এবং একইসাথে মানসিক কনসালটেন্ট। মেন্টাল হেলথ, মেন্টাল হেলথ নার্সিং ও সাইক্রিয়াট্রি নিয়ে দেশের বাহিরে পড়াশোনা করেছেন। বাবার ও নিজের পেশাগত কারণে ঘুরে বেড়িয়েছেন নিজের দেশ ছাড়াও বিদেশের বিভিন্ন প্রান্তে। সর্বশেষ তিনি ইংল্যান্ডের একটি বেসরকারি মানসিক হাসপাতালে ডেপুটি ম্যানেজার ও ক্লিনিক্যাল লিড হিসেবে কাজ করেছেন। তাই থিউরিটিক্যাল জ্ঞান ও বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি বাস্তব গল্পগুলোকে লেখনীর মাধ্যমে প্রাণবন্ত ও সতেজ করে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন৷ এ সবেরই বাস্তব ফল হলো লেখকের এই গ্রন্থটি।
বইটি এক কথায় : ইউরোপ ও পাশ্চাত্য সংস্কৃতির মানুষের মনের বিচিত্র জগৎ, স্মৃতিচারণমূলক ও বাস্তবমুখী জীবন-দর্শন নিয়ে নির্মিত।
প্রেক্ষাপট: সভ্যতা, আধুনিকতা, সংস্কৃতির জন্য এবং নারী স্বাধীনতার স্বর্গভূমি হিসেবে ইউরোপ ও পশ্চিমাদের জীবন প্রেক্ষাপটে গ্রন্থটি রচিত।
সারমর্ম: শিল্পবিপ্লবের পর পাশ্চাত্য ও ইউরোপের পরিবার-কাঠামো তুলে ধরা হয়েছে বইটিতে। পরস্পরকে বেঁধে রাখার শক্তি তারা হারিয়েছে, যার ফলস্বরুপ মেয়ে তার ডিভোর্সী মায়ের স্বামী ( আপন বাবা না)-কে নিয়ে পালিয়ে যায় , বাবা তার সন্তানদের অবহেলায় মানসিক রোগী হয়। হঠাৎ একদিন আদালতের কল্যাণে সন্তান জানতে পারে, সে তার মায়ের সন্তান না; এমনকি তার জন্মদাতা বাবা কে-সে তা জানে না। পরিত্যক্ত সন্তানের মনে বাবার জন্য কত হাহাকার!
বয়স আঠারো হবার পর মেয়েকে তার নিজ দায়িত্ব নিতে হয়; এমনকি মাথার ওপর বটগাছসদৃশ অভিভাকত্ব পর্যন্ত সে হারায়। বাবা-মায়ের মৃত্যুর খবর শোনার পর সন্তানের যাওয়ার সময় হয় না। কারণ, সে বস্তুবাদিতার এই জগৎ নিয়ে কঠিন ব্যস্ত। শেষ বয়সে বাবা-মায়ের শেষ ঠিকানা হয় বৃদ্ধাশ্রম। পৈশাচিক কারও সুখের পেছনে, বিলাসিতার আড়ালে লুকিয়ে থাকে অনেক মানুষের দুঃখ, যন্ত্রণা আর জুলুম। কিছু গল্প আছে মুসলিম নামক হায়েনাদের নিয়ে, যারা এই পাশ্চাত্য সভ্যতাকে নিজেদের জীবনব্যবস্থা হিসেবে গ্রহণ করেছেন।
আসলে পরিবার হলো রাষ্ট্রের ফাউন্ডেশন, আর সেই পরিবারেই যদি এত অনৈতিকতা থাকে এবং মূল্যবোধহীন হয়ে পড়ে, তাহলে হতাশা আর বিশ্বাসহীনতা তাদের নিত্য সাথি হয়ে যায়।
কিছু গল্পের রিভিউ:
→সিক্স সেভেনটি ফাইভ ওয়েল বেকরোড :
বিল এক মুহূর্তের জন্য কাছে পেয়ে বলে ফেলল-
জিয়া! উইল ইউ ব্রিং মাই ড্যাড ব্যাক টু মি?"
এই কথা শোনার পর আমার (লেখকের) মুখ থেকে কোনো কথা সরছে না। বিলের গাড়িটি দূর থেকে দূরে দৃষ্টির শেষ সীমানায় চলে যায় ।
আরেক দিন আমার (লেখকের) বাবার ছবি দেখে বিল বলল-
জিয়া! তুমি কি জানো, আমার বাবা কোথায়?"
সেদিন আমি বিরাট এক ধাক্কা খেলাম।
হ্যাঁ, বিল তার বিধবা বৃদ্ধা নানি জিলিয়ানের সাথে থাকে। তারা লেখকের প্রতিবেশী।
বিলের মা নিজেও জানে না বিলের বাবা কে। কী বীভৎস!
শেষ অব্দি বিলের মা অন্য একজনের সাথে চলে যায় ।
এই গল্পে আপনি জানবেন একটা শিশুর একা, একা বেড়ে উঠার যন্ত্রণার কথা, বাবা কে না দেখার আকুতি।
বিলের নানির ,বিলের মা ব্যতীত আরও দুটো সন্তান আছে তবুও কেনো তিনি একা থাকেন ।
হ্যাঁ পাঠক! এই সব প্রশ্নের উওর গল্পটি পড়ার পর জানতে পারবেন৷ আর লিখে আপনাদের গল্প পড়ার রুচি নষ্ট করতে চাই না।
ন্যান্সি ও লায়লার সঙ্গে এক প্রহর :
মানসিক রোগী ডেবিট পার্কারের স্ত্রী হলো ন্যান্সি পার্কার। তাদের চার ছেলে মেয়ে। তারা যে যার মতো সিদ্ধান্ত নিল জীবন নিয়ে । পাড়া প্রতিবেশীর মতো তারা খবর শুনেছিল; বাবা-মা হিসেবে না। প্রত্যেকে বাবা মাকে ছেড়ে চলে গেল।
বাবা-মা হিসেবে বেশি কিছু বলতে পারেনি সেদিন তারা। কারণ, বেশি কিছু বললে মেয়ে উলটো বাবা-মায়ের বিরুদ্ধেই চাইল্ড এবিউজড-এর মামলা করে দেবে।
পাঠক! এই হলো নারী স্বাধীনতার স্বর্গভূমি ইউরোপ।
একপর্যায় ডেবিট পার্কার চার সন্তানের বিরহে মানসিক রোগী হয়ে যান।
তবে পাঠক! এই গল্পটা কিন্তু পজিটিভ দিকে গিয়েছে।
তাদের ছোট মেয়ে লোরা একসময় মুসলিম হয়ে লায়লা নাম গ্রহণ করে এবং অবশেষে পিতা-মাতার কাছে ফিরে আসে।
ছোট মেয়ের মুসলিম হওয়ার গল্প, বাবা মায়ের কাছে ফিরে আসের গল্প, মুসলিম হওয়ার পিছনে লেখকের পরোক্ষ অবদান ইত্যাদি গল্পটি পড়ে জানুন।
একজন মুহাম্মদ তাওফিক :
আমি (লেখক) তাকে বললাম, তোমাকে মানসিকভাবে শক্ত হতে হবে; নতুবা বাবার সাথে দেখা করতে পারবে না।
সে কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল-
আমি ঠিক পারব। বাবাকে দেখার জন্য আমি আমার ফেরেস্তাসম স্বামীকে তালাক দিয়েছি। বাবাকে দেখার জন্য পশুর চেয়ে নিকৃষ্ট এক জর্ডানিকে বিয়ে করে আট বছর সংসার করেছি শুধু একটি পাসপোর্টের জন্য। পাসপোর্ট পাওয়ার পর ভিসা পাইনি রাজনৈতিক কারণে। এরপর আরও ১০ বছর অপেক্ষা করেছি ভিসার জন্য, এই সময়ের প্রতিটি মুহূর্ত কাটা কবুতরের মতো ছটপট করেছি।
জানো? ফিলিস্তিনি না হলে আমাদের জীবনটা এমন হতো না!
পাঠক! কল্পনা করুন তো, বাবাকে দেখার জন্য একজন মেয়ের ত্যাগ!
জানেন, তার বাবাও কিন্তু হাসপাতালের করিডোরে, পত্রিকার পাতায় এভাবেই প্রাণপ্রিয় স্ত্রী ও কন্যাকে খুঁজে ছিলেন প্রতিনিয়ত।
বাবার গল্পটি নাহয় বইটি পড়ে জানুন।
বাবার সাথে বিচ্ছেদের গল্প,
বাবার মানসিক রোগি হওয়ার পিছনের গল্প, ইজরাইলিদের হামলার কাহিনি বইটি পড়লে জানতে পারবেন৷
যে গল্পটি বেশি মনে ধরেছে :
তোমাকে করি নমস্কার।
কারন এখানে একজন মিশরী মুসলিম মহিলা ডাঃ একজন বাংলাদেশি ধর্ষিতা তরুণীর জন্য বিদেশের মাটিতে অনেক চ্যালেঞ্জ নিয়েছন, ত্যাগ দিয়েছেন, হুমকির সম্মুখীন হয়েছেন, চাকুরী পর্যন্ত ছেড়েছেন।
বাংলেদেশের তরুণী ধর্ষিতা হয়েছিল গৃহকর্তীর স্বামী, ছেলে, শশুরের কাছে।
যে গল্পগুলো আমার বেশি ভালো লেগেছে-
→খোকন শোনা বলি শোনো
→সে আমার ছোট বোন বড় আদরের
→আমার ও মায়ের মূল্য কত।
→টাইম : দা অ্যাভেঞ্জার
→শোনো বাহে জাতিসংঘ তারেই কহে
→গুডলাক পলিন।
→মাইন্ড ইউর বিজনেস।
বাস্থবজীবন নিয়ে রচিত ২৮টি গল্প আমার হৃদয় ছুঁয়ে গিয়েছে। তবে পাঠকের রুচিভেদে কিছু গল্পের ক্ষেত্রে ভালোলাগার তারতম্য হতেই পারে। আমার অন্তরে বেশি দাগ কেটেছে যেগুলো, আমি সেগুলোর লিস্ট দিলাম।
বইটি কেন পড়বেন :
→দুঃখ, ব্যথা ও বেদনার যে কত শাখা-প্রশাখা এবং তার যে কত গভীরতা থাকে, তা জানতে হলে ধরণির পথে পথে অবশ্য পাঠ্য।
→নারী স্বাধীনতার স্বর্গভূমি ইউরোপে নারীকে তার অধিকারসহ কতটা মূল্যায়ন করা হয়, কতটুকু ভালোবাসে- তা জানতে হলেও অন্তত বইটি পড়বেন।
→পশ্চিমা ও ইউরোপের পারিবারিক ও সামাজিক কালচারকে পারিবারিকভাবে জানার জন্যও বইটি পড়তে পারেন।
বইটি কাদের জন্য :
যে কোনো রিলিজিয়ন ও মতের মানুষ পড়তে পারবেন, তবে স্পেশালি আমি মুসলিম উইমেনদের সাজেস্ট করব- যারা পশ্চিমা কালচারের আলোকে নিজেদের জীবনধারণ করতে চায়।
রিভিউ লেখার উদ্দেশ্য :
অন্যের জীবন দেখে নিজের জীবনবোধকে জাগ্রত করে পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় করার জন্য।
ভাষা : সহজ, সরল, প্রাঞ্জল।
সমালোচনা :
→ সাহিত্যিক মান আরও বৃদ্ধি করা যেত।
→একটি বইয়ের দায় শুধু লেখকের না; প্রকাশনীরও।
উপসংহার : পরিবার-পরিজনের সাথে আত্মার সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। যৌবনে আত্মার সাথে আত্মীয় না করলে, এড়িয়ে গেলে বৃদ্ধ বয়সে তার খেসারত দিতে হবে। সম্পর্কে মধ্যে দায়িত্ববোধ ও নৈতিকতাবোধ তৈরি করা তাই সময়ের দাবি।
লেখক: জিয়াউল হক
প্রকাশনী: গার্ডিয়ান পাবলিকেশন্স
পৃ: ২০৮
গল্প সংখ্যা: ২৮টি
মূল্য: ৩৫০